
ইসরাইল ফিলিস্তিন মানচিত্র ইতিহাস: ১৯৪৭ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত পরিবর্তনের বিস্তারিত
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি একটি ভূখণ্ডের ইতিহাসও। যেখানে যুগে যুগে মানচিত্র বদলেছে যুদ্ধ, দখল, চুক্তি ও জাতিসংঘের প্রস্তাবের কারণে। এই পোস্টে আমরা বিশ্লেষণ করব—কিভাবে সময়ের সাথে সাথে ফিলিস্তিনি অঞ্চল সঙ্কুচিত হয়েছে এবং ইসরাইলি ভূখণ্ড বেড়েছে।
ইসরাইল ফিলিস্তিন ম্যাপ : যুদ্ধ, প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক পালাবদলের ইতিহাস
১৯৬৭: ছয় দিনের যুদ্ধ (نَكْسَة – Naksa)
১৯৪৯ সালের অস্ত্রবিরতির পর ফের ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের মেঘ জমে। আরব রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বে (বিশেষ করে মিশর ও সিরিয়া) ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি আঁচ করে আগাম হামলা চালায় ইসরায়েল। মাত্র ছয় দিনে (৫ জুন – ১০ জুন) ইসরায়েল পশ্চিম তীর, জর্ডান-নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জেরুজালেম, এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
📌 এই যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমি দখলের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে অনেকেই একে "আরব বিশ্বের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক পরাজয়" হিসেবে দেখেন।
১৯৭৩: ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ
ইহুদি ধর্মীয় দিন ইয়োম কিপপুর উপলক্ষে ইসরায়েল যখন প্রস্তুতিহীন, তখন মিশর ও সিরিয়া যৌথভাবে সুয়েজ খাল ও গোলান মালভূমি এলাকায় ইসরায়েলি স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। প্রথমদিকে আরব বাহিনী সাফল্য পেলেও, তিন সপ্তাহের মধ্যেই ইসরায়েল শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আগ্রাসন ঠেকিয়ে দেয়।
১৯৮২: লেবানন আগ্রাসন
১৯৮২ সালে ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ চালায়। লক্ষ্য ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) এবং এর নেতা ইয়াসের আরাফাত। ১০ সপ্তাহের সংঘর্ষে হাজারো ফিলিস্তিনি যোদ্ধা লেবানন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
২০০৬: হেজবুল্লাহ বনাম ইসরায়েল
লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ ২০০৬ সালে দুই ইসরায়েলি সেনা অপহরণ করলে উত্তেজনা বাড়ে। এর জেরে ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালায়। ৩৪ দিনের এই যুদ্ধে লেবাননের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তবে হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
গাজা: হামাস, রকেট হামলা ও ইসরায়েলি বিমান হামলা
১৯৬৭ সালে দখল করা গাজা উপত্যকা ২০০৫ সালে ছেড়ে দেয় ইসরায়েল। কিন্তু গাজার নিয়ন্ত্রণে আসে হামাস। এরপর থেকেই শুরু হয় রকেট হামলা ও পাল্টা বিমান হামলার চক্র।
ইতিহাসভিত্তিক ম্যাপ পরিবর্তনের ধারা
১. ১৯৪৭: জাতিসংঘের প্রস্তাবিত বিভাজন পরিকল্পনা
ঘটনা: জাতিসংঘের রেজুলুশন ১৮১ অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র, অন্যটি আরব রাষ্ট্র।
ম্যাপ চিত্র:
- ইহুদি রাষ্ট্র: ৫৫%
- আরব রাষ্ট্র: ৪৫%
- জেরুজালেম: আন্তর্জাতিক অঞ্চল
⚠️ ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, কারণ তারা নিজেদের অধিকারের ৫৫% হারাতে রাজি ছিল না।
২. ১৯৪৮-৪৯: ইসরাইলের স্বাধীনতা এবং প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ
ঘটনা: ১৯৪৮ সালে ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আরব রাষ্ট্রগুলো হামলা করে। ইসরাইল যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং আরও অধিক ভূখণ্ড দখল করে।
ফলাফল:
- ইসরাইল ৭৮% ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনে
- জর্ডান নিয়ন্ত্রণ নেয় পশ্চিম তীর (West Bank)
- মিশর নিয়ন্ত্রণ নেয় গাজা স্ট্রিপ
৩. ১৯৬৭: ছয় দিনের যুদ্ধ (Six-Day War)
ঘটনা: ইসরাইল ৬ দিনের যুদ্ধে জর্ডান, মিশর, ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে।
ফলাফল:
- ইসরাইল পশ্চিম তীর, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান হাইটস দখল করে
- ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি ছিল সর্বোচ্চ ভূখণ্ড ক্ষতি
📌 এই সময় থেকেই অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরাইল।
৪. ১৯৯৩: অসলো চুক্তি
ঘটনা: প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) ও ইসরাইলের মধ্যে চুক্তি হয়।
ফলাফল:
- ফিলিস্তিনিদের জন্য সীমিত স্বশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়
- পশ্চিম তীরকে ভাগ করা হয় ৩ ভাগে:
- এ এরিয়া: পূর্ণ ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রণ
- বি এরিয়া: যৌথ নিয়ন্ত্রণ
- সি এরিয়া: সম্পূর্ণ ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ (প্রায় ৬০%)
৫. ২০০৫: গাজা থেকে ইসরাইলি প্রত্যাহার
- ঘটনা: ইসরাইল গাজা স্ট্রিপ থেকে সকল সেনা ও বসতি তুলে নেয়
- তবে: গাজার আকাশ, সীমান্ত ও সাগর পথ ইসরাইল নিয়ন্ত্রণে রাখে
২০০৭-২০২৫: গাজা-ইসরাইল সংঘাত ও অবরোধ
হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়, এবং এর পর থেকে গাজা চরম অবরোধের মুখে পড়ে।
ইসরাইল ও গাজার মধ্যে একাধিক যুদ্ধ হয়, যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও গাজায় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়।
ইসরাইল ফিলিস্তিন ম্যাপ পরিবর্তনের সারসংক্ষেপ
সাল | ঘটনা | ফিলিস্তিন ভূখণ্ড | ইসরাইল ভূখণ্ড |
---|---|---|---|
১৯৪৭ | জাতিসংঘ বিভাজন | ৪৫% | ৫৫% |
১৯৪৮ | ইসরাইল স্বাধীনতা যুদ্ধ | ২২% | ৭৮% |
১৯৬৭ | ছয় দিনের যুদ্ধ | ০% কার্যকর নিয়ন্ত্রণ | ১০০% কার্যকর নিয়ন্ত্রণ |
১৯৯৩ | অসলো চুক্তি | সীমিত স্বশাসন | সি এরিয়া নিয়ন্ত্রণ |
২০০৫ | গাজা প্রত্যাহার | গাজা শাসন | বেষ্টনী অব্যাহত |
২০২৫ | চলমান যুদ্ধ | গাজা ধ্বংসপ্রায় | বসতি সম্প্রসারণ চলমান |
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ম্যাপ পরিবর্তনের ইতিহাস | যুদ্ধ ও দখলের চিত্রসহ বিশ্লেষণ
ইসরায়েলের সৃষ্টি
ইসরায়েলি -ফিলিস্তিনি সংঘাতের ইতিহাস ১৯ শতকের শেষের দিকে ফিরে আসে যখন ইহুদিরা অটোমান-নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল , যা ইহুদি ঐতিহ্যে ইস্রায়েলের ভূমির সাথে প্রায় মিল ছিল । ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারি করা ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণাপত্রে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি স্বদেশের ধারণাটি সমর্থন করা হয়েছিল, যার ফলে এই অঞ্চলে ইহুদি অভিবাসীদের আগমন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্টের পর, ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পায় , যার ফলে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের সৃষ্টি হয় ।

ছবিঃ আজকের অঞ্চল: ইসরায়েল , পশ্চিম তীর , গাজা উপত্যকা এবং গোলান মালভূমি
ফিলিস্তিনের ইতিহাস বিস্তারিত পড়ুনঃ
ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের মূল কারণগুলো কী? ইতিহাস, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত (যেখানে বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড অবস্থিত)। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। এটি ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের জন্মস্থান। ভৌগোলিক অবস্থান ও দুটি প্রধান ধর্মের সূতিকাগার হওয়ায় স্বভাবতই ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডটির রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনীতির এক দীর্ঘ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের এই সম্পূর্ণ ভূ-খণ্ড বা এর কোনো কোনো অংশ বিভিন্ন রকমের মানুষদের দ্বারা পরিচালিত ও শাসিত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে আছে- কেনানীয়, আরামীয়, প্রাচীন মিশরীয়, ইসরায়েল বংশের ইহুদি, ব্যাবিলনীয়, পারস্য, প্রাচীন গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইনীয়, প্রাথমিক যুগের মুসলিম খিলাফাত (যেমনঃ উমাইয়া, আব্বাসীয়, সেলজুক, ফাতিমি প্রভৃতি), খ্রিস্টান ক্রুসেডার বা ধর্মযোদ্ধাগণ, শেষের দিকের মুসলিম খিলাফাত (যেমনঃ আইয়ুবি, মামলুক, উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রভৃতি), ব্রিটিশ, জর্ডানি (পশ্চিম তীর অংশটুকু), মিশরীয় (গাজা অঞ্চল), এবং হাল আমলের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সহ এরকম বহু জাতি ও অঞ্চলের ব্যক্তি ও শাসকবর্গ। ফিলিস্তিনের অপরাপর নামগুলো হলোঃ কনান, জায়ন, ইসরায়েলের ভূমি, দক্ষিণ সিরিয়া, জুন্দ ফিলিস্তিন এবং পবিত্র ভূমি।

ছবিঃ ১৮৫১ সালে উসমানীয় ফিলিস্তিনের একটি মানচিত্র।
জাফা এবং হাইফার মতো প্রধান আরব জনগোষ্ঠী কেন্দ্রগুলিতে হাগানাহ কর্তৃক আক্রমণ এবং দেইর ইয়াসিন এবং লিড্ডার মতো ইরগুন এবং লেহির মতো গোষ্ঠীগুলির দ্বারা পরিচালিত বহিষ্কারের ফলে আরব জনগণের একটি বিশাল অংশ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। ফিলিস্তিনি অভিজাতদের পূর্বের পলায়ন এবং ইহুদি নৃশংসতার মানসিক প্রভাব (যা গল্প উভয় পক্ষই প্রচার করেছিল) এর মতো কারণগুলিও ফিলিস্তিনি পলায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের জয় হয়, ইসরায়েল বিভক্তির সীমানার বাইরে একটি প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য এবং প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি আরব রাষ্ট্রের জন্য সীমানায় অঞ্চল সংযুক্ত করে। জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন এবং মিশর ইসরায়েলের সাথে 1949 সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে । অবশিষ্ট অঞ্চল, গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীর যথাক্রমে মিশর এবং ট্রান্সজর্ডান দ্বারা দখল করা হয়েছিল । জর্ডানও পূর্ব জেরুজালেমকে সংযুক্ত করে যখন ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেম পরিচালনা করে । 1950 সালে, পশ্চিম তীর একতরফাভাবে জর্ডানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ছবিঃ ১৯৪৭ সালের ফিলিস্তিনের জন্য জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা
আরো পড়ুনঃ
ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থা ২০২৫
📸 ম্যাপ চিত্র (বর্ণনামূলক)
আপনি চাইলে নিচের চিত্র গুলো যুক্ত করতে পারেন (কনটেন্টে অথবা ইনফোগ্রাফিক হিসেবে):
১৯৪৭ জাতিসংঘ পরিকল্পনা ম্যাপ
১৯৪৯ যুদ্ধ পরবর্তী ম্যাপ
১৯৬৭ পরবর্তী ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল
বর্তমান ম্যাপ: ইসরাইলি বসতি, সীমানা দেয়াল ও অবরোধ চিত্র
রেফারেন্স ও তথ্যসূত্র:
- জাতিসংঘ রেজুলুশন ১৮১ (1947)
- Oslo Accords (1993)
- Amnesty International Reports
- Human Rights Watch – Israel/Palestine Updates
- Al Jazeera & BBC Palestine Timeline
উপসংহার
ইসরাইল-ফিলিস্তিন ম্যাপের ইতিহাস হলো এক দীর্ঘ সংঘাত, প্রতিরোধ ও ভূখণ্ড হারানোর গল্প। একটি সময় ছিল যখন ফিলিস্তিনি জনগণের হাতে ছিল পুরো ভূমি, এখন তারা সীমিত একটি অংশেও স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না। এই ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু মানচিত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্বের ইতিহাস।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.