
পবিত্র আশুরা বা মুহররম কি? ইতিহাস, ফজিলত ও রোজার গুরুত্ব | ইসলামিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ
মুহররম বা আশুরা কী? ইসলামে এর গুরুত্ব
“আশুরা” শব্দটি আরবি “আশারা” (عشرة) থেকে এসেছে, যার অর্থ 'দশ'। অর্থাৎ, এটি মুহররম মাসের ১০ তারিখ। ইসলামের পূর্বেও ইহুদিরা এই দিনটি পালন করত, কারণ এ দিনেই নবী মূসা (আ.) আল্লাহর সাহায্যে ফেরাউনকে পরাজিত করেন এবং বনি ইসরাইলকে মুক্তি দেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
"আমি মূসার চেয়ে তার (সত্য ও বিজয়ের) বেশি হকদার।"
(সহিহ বুখারি)
আশুরা (আরবি: عاشوراء) হল মহররম মাসের ১০ তারিখ, যা ইসলামী বর্ষপঞ্জির অন্যতম পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনটি ইসলামের ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা অনেক নবীকে বিশেষ রহমত, মুক্তি ও বিজয় দান করেছিলেন। যেমন—এই দিনেই নবী মূসা (আ.) ফেরাউনকে পরাজিত করে বনি ইসরাইলকে মুক্তি দেন, এবং নুহ (আ.)-এর কিস্তি জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে। এ কারণে নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর দেখতে পান, ইহুদিরা আশুরা পালন করছে। তিনি তখন বলেন, “আমরা মূসার চেয়ে বেশি হকদার।” এরপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা রাখতে উৎসাহ দেন (সহিহ মুসলিম)।
তবে ইসলামে আশুরার গুরুত্ব শুধু অতীত ইতিহাসের জন্য নয়, বরং এটি ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর উপর আস্থা রাখার প্রতীক। হাদিসে এসেছে, আশুরার রোজা বিগত বছরের ছোট গুনাহসমূহ মোচনের উপায় (সহিহ মুসলিম)। পাশাপাশি, মুসলিম বিশ্বে এই দিনটি কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার স্মরণেও পালিত হয়, যখন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শহীদ হন। তাই আশুরা শুধু শোক নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের অনুপ্রেরণা।
আশুরার দিনে রোজা রাখা, বেশি করে ইবাদত করা, দান-সদকা করা, এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা ইসলামী শিক্ষার অংশ। এটি মুসলিমদের আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক শক্তি জোগায়। এই পবিত্র দিন মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সত্যের পথে সবসময় ত্যাগ ও ধৈর্যের প্রয়োজন, আর আল্লাহর রহমত ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই থাকে।
মুহররম ও আশুরার ফজিলত – হাদিস অনুযায়ী
বিগত বছরের গুনাহ মাফ হওয়ার সুযোগ
হাদিস:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন –
"আমি আশা করি, আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহসমূহ মোচন করে দেয়।"
— (সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
🔹 এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, আশুরার রোজা রাখা পূর্ববর্তী বছরের ছোটখাটো গুনাহ মোচনের একটি বিশাল সুযোগ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিরাট রহমত।
নবী মূসা (আ.) এর বিজয়ের দিন
হাদিস:
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন –
“রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন, ইয়াহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন: ‘তোমরা কেন এই দিনে রোজা রাখো?’ তারা বলল: ‘এই দিন আল্লাহ মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে ডুবিয়েছিলেন। এজন্য আমরা রোজা রাখি।’
তখন রাসুল (সা.) বলেন:
"আমরা মূসার চেয়ে অধিক হকদার।"
তারপর তিনি সেদিন রোজা রাখেন এবং সাহাবাদেরও রাখতে আদেশ দেন।
— (সহিহ বুখারি: ২০০৪, সহিহ মুসলিম: ১১৩০)
🔹 এই হাদিসে বোঝা যায়, আশুরা শুধুই ইসলামী ঐতিহ্য নয়, বরং নবীদের স্মরণে ও ন্যায়ের পক্ষে আত্মত্যাগের একটি দিন।
বিস্তারিত পড়ুনঃ
তাহাজ্জুদ নামাজ: সময়, ফজিলত, নিয়ত, মর্যাদা ও ফজিলত
আশুরার রোজা রাখা সুন্নত
হাদিস:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন –
"তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো এবং তা থেকে ইহুদিদের ভিন্ন করার জন্য একদিন আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখো।"
— (মুসনাদে আহমাদ: ২১৫৪)
🔹 তাই অনেকে ৯ ও ১০ মহররম বা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখেন।
✅ সংক্ষেপে আশুরার ফজিলত:
ফজিলত | ব্যাখ্যা |
---|---|
১. | এক বছরের গোনাহ মোচনের সুযোগ |
২. | ন্যায়ের পক্ষে নবী মূসার বিজয় স্মরণ |
৩. | কারবালার আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা থেকে শিক্ষা |
৪. | রাসুল (সা.) নিজে রোজা রেখে উম্মতকে উৎসাহ দিয়েছেন |
আশুরার রোজার ফজিলত
ইসলামে আশুরার দিন অর্থাৎ মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও মুস্তাহাব (সুন্নাত) আমল। এই রোজা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"আমি আশা করি, আশুরার রোজা আগের এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।"
— (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
এই হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, আল্লাহর রহমতে আশুরার একদিনের রোজা রাখলে বিগত এক বছর যাবৎ যে ছোট ছোট (সগিরা) গুনাহ হয়েছে, তা ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এটি আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত ও মাফের দরজা। তবে, এই রোজা ফরজ নয়, বরং রাসুল (সা.) নিজে রেখেছেন এবং সাহাবাদেরও রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন,
"তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো এবং ইহুদিদের ভিন্ন করার জন্য এর সঙ্গে একটি অতিরিক্ত দিন রাখো—৯ বা ১১ তারিখে।"
— (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২১৫৪)
তাই ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখলে তা উত্তম। এতে ইহুদি-খ্রিস্টানদের অনুকরণও এড়ানো হয় এবং মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে।
আশুরার রোজা শুধু গুনাহ মোচনের মাধ্যম নয়, বরং এটি নবী মূসা (আ.)-এর বিজয়, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান, এবং কারবালার আত্মত্যাগের স্মারকও বটে। তাই মুসলমানদের উচিত, এ দিনে রোজা রাখা, তওবা করা, গুনাহ থেকে ফিরে আসা ও বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
বিস্তারিত পড়ুনঃ
কুরআনের আলোকে বিবাহ: নিছক সামাজিক চুক্তি নয়, বরং ইবাদত
মহররম ও আশুরা: কী এবং কীভাবে ভিন্ন?
মুহররম (Muharram) হল ইসলামি চান্দ্র বছরের প্রথম মাস। এটি হিজরি বর্ষপঞ্জির অন্যতম পবিত্র চার মাসের একটি, যাকে কুরআনে “আশহুরুল হুরুম” বলা হয়েছে (সূরা তাওবা ৯:৩৬)। এই মাসটি সম্মানিত হওয়ার কারণে এতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ, এবং এটি আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের জন্য বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।
অন্যদিকে, আশুরা (Ashura) হলো মুহররম মাসের ১০ তারিখ, যা এই মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইসলামি ইতিহাসে আশুরা বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার স্মারক—যেমন, নবী মূসা (আ.)-এর ফেরাউন পরাজিত করার দিন, ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কারবালায় শাহাদাত ইত্যাদি।
📌 সহজ ভাষায় বললে:
বিষয় | মুহররম | আশুরা |
---|---|---|
সংজ্ঞা | হিজরি বছরের প্রথম মাস | মুহররম মাসের ১০ম দিন |
গুরুত্ব | চারটি পবিত্র মাসের একটি | রোজা, আত্মত্যাগ ও ঐতিহাসিক ঘটনার দিন |
ইবাদত | নফল রোজা, তাওবা, দান | বিশেষ রোজা, দোয়া ও শিক্ষা নেওয়ার দিন |
🔹 মুহররম একটি সম্পূর্ণ মাস,
🔹 আশুরা সেই মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।
⚠️ আশুরায় যে কাজগুলো থেকে বিরত থাকবেন
❌ শোক পালনের নামে মাতম বা নিজেকে আঘাত করা
❌ বিদআতমূলক অনুষ্ঠান
❌ নির্ভরযোগ্য হাদিস ব্যতীত রেওয়ায়েত প্রচার
ইসলামি ইতিহাসে আশুরা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যা হিজরি সালের প্রথম মাস মুহররমের ১০ তারিখে পালন করা হয়। এই দিনটি শুধু শোক ও স্মৃতির দিন নয়, বরং এটি ত্যাগ, বিজয়, রোজা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। রাসুল (সা.) নিজে আশুরার রোজা রেখেছেন এবং উম্মতকে তা রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন।
FAQ
প্রশ্ন: আশুরা কেন পালন করা হয়?
উত্তর: ইসলামী ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেমন নবী মূসার বিজয় এবং কারবালার আত্মত্যাগ এ দিনে সংঘটিত হয়। সেই স্মরণে এটি পালন করা হয়।
প্রশ্ন: আশুরার রোজা ফরজ কি?
উত্তর: না, এটি ফরজ নয়; তবে রাসুল (সা.) নিজে রোজা রেখেছেন এবং তা রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন, তাই এটি সুন্নত ও ফজিলতপূর্ণ।
প্রশ্ন: শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখলে হবে?
উত্তর: হবে, তবে ৯ অথবা ১১ তারিখ মিলিয়ে দুদিন রাখলে উত্তম, কারণ এতে ইহুদিদের অনুকরণ হয় না।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.