Maulana-Bhashani_1751863640.jpg

মাওলানা ভাসানী জীবনী, জন্ম, মৃত্যু, কবর ও রাজনৈতিক দর্শন

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০/৮১ – ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬) ছিলেন উপমহাদেশের একজন কিংবদন্তি রাজনীতিক, মজলুম জননেতা নামে খ্যাত। তিনি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং বাম রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধর্মীয় চিন্তাভাবনা এবং দুর্দান্ত নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে।

 

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল নিপীড়িত মানুষের মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের উপর ভিত্তি করে গঠিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত রাজনীতি হলো জনগণের কল্যাণে কাজ করা এবং ক্ষমতার লোভ বা ব্যক্তিস্বার্থে নয়। তাঁর রাজনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীল চিন্তার সমন্বয়। যদিও তিনি একজন ইসলামি পণ্ডিত ছিলেন, তবুও ধর্মকে তিনি রাজনৈতিক বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি। বরং তিনি ধর্মের নৈতিকতা ও মানবিক দিককে রাজনৈতিক চেতনায় রূপান্তর করেছিলেন। কৃষক-শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছিল তাঁর রাজনীতির মূল স্তম্ভ। ভাসানী বিশ্বাস করতেন, ক্ষমতা মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত না হলে সেই রাজনীতি জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়। “মজলুম জননেতা” হিসেবে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন যে, একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ কেবল কথার মানুষ নন, কাজের মানুষও হতে হয়। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন আজও সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং জাতীয় স্বার্থে নিবেদিত রাজনীতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

 

মাওলানা ভাসানীর জীবনী,  জন্ম, মৃত্যু

🟩 জন্ম ও বেড়ে ওঠা

মাওলানা ভাসানীর জন্ম ১৮৮০ বা ১৮৮১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল হাজী শরফুদ্দিন খান। তিনি খুব অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান। এরপর তিনি নানা ও মামার তত্ত্বাবধানে বড় হন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় মনোযোগী ছিলেন। তিনি নিকটবর্তী মক্তব ও মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। পরে সিলেট, দেওবন্দ এবং কলকাতার বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলামি শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন দেওবন্দি চিন্তাধারায় প্রভাবিত এবং রাজনীতিতে তার নৈতিকতা ও আদর্শিক দৃঢ়তা এর প্রভাব বহন করে।

🟩 মাওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে প্রবেশ ও উত্থান

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে।
১৯১৯ সালে খিলাফত আন্দোলন এবং নন-কো-অপারেশন মুভমেন্ট-এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। এই সময় থেকেই তিনি ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁর উপর নজরদারি শুরু করে।

১৯৪০-এর দশকে তিনি আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি হন এবং বাংলার কৃষকদের জন্য ভূমি সংস্কার, জমিদারদের দমন এবং অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন।

🟩 আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরবর্তীতে বাম ধারায় ঝোঁক

১৯৪৯ সালে ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) গঠনের সময় তিনি ছিলেন দলটির প্রথম সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বেই দলটি পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

তবে পরবর্তীতে দল ভিন্ন পথে গেলে ১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP) গঠন করেন। এই দলটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বামপন্থী এবং প্রগতিশীল রাজনীতির কেন্দ্র।

🟩 কৃষক ও মেহনতি মানুষের নেতা

মাওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের অকুতোভয় কণ্ঠস্বর। তিনি ঢাকা শহরের 'কৃষক-প্রজার মিছিল', কাগমারী সম্মেলন, ভুটান, কান্দাহার, টুঙ্গিপাড়া বা মওকা ছাড়া রাজনীতি নয় — এই ধরনের ঐতিহাসিক বক্তব্য ও কার্যক্রমে সাধারণ মানুষের মাঝে অমর হয়ে আছেন।

তিনি "মজলুম জননেতা" (Leader of the Oppressed) নামে পরিচিত ছিলেন।

🟩 ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার

ভাসানী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেন এবং ছাত্রদের পাশে ছিলেন। পরবর্তীতে ছয় দফার সময়ে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে দাঁড়ান। তবে তিনি কখনো আওয়ামী লীগের মত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেননি।

🟩 মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাঁকে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে দাফন করা হয় — যেখানে তিনি কৃষকদের জন্য একটি শিক্ষা ও রাজনীতি কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন।

বিস্তারিত পড়ুনঃ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল কয়টি ও কী কী |   বিস্তারিতসহ পূর্ণ তালিকা 2025

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন:বিস্তারিত

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল জনগণকেন্দ্রিক, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং ধর্ম, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত। তিনি ছিলেন একাধারে ইসলামি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, আবার বামপন্থী রাজনীতির এক অনন্য প্রতিনিধি। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল: জনগণের অধিকার আদায়, কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি, শোষণবিরোধী সংগ্রাম, জাতীয় স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের সম্মান

🟢 সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান

ভাসানীর দর্শনের কেন্দ্রে ছিল কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত রাজনীতি মানে হলো শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করা। তিনি জমিদার, দালাল শ্রেণি ও শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। ‘মজলুম জননেতা’ খেতাবটি তিনি পেয়েছিলেন এ কারণেই যে তিনি সব সময় শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কথা বলতেন।

🟢 ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয়

যদিও তিনি মাওলানা ছিলেন এবং ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, তবুও তিনি কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতিতে প্রাধান্য দেননি। তাঁর ভাষায়, “আমি মুসলমান, কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষও সমান অধিকার পাবে।” তিনি ইসলামের ন্যায়ের বাণীকে রাজনৈতিক মূল্যবোধে পরিণত করেন এবং ধর্মকে বিভেদ নয়, ঐক্যের শক্তি হিসেবে দেখতেন।

🟢 বামপন্থী ও প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাস

ভাসানী ছিলেন বাম রাজনীতির ধারক ও বাহক। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিপীড়ন, বৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি গণআন্দোলন, ধর্মঘট, প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন। তাঁর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP) ছিল একমাত্র জাতীয় পর্যায়ের বামপন্থী শক্তি, যেটি পাকিস্তানি মিলিটারি সরকারের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত প্রতিবাদ গড়ে তোলে।

🟢 সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও স্বাধীন চেতা মনোভাব

মাওলানা ভাসানী সবসময়ই সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য, আমেরিকান সামরিক প্রভাব এবং উপনিবেশবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি চীনের বিপ্লব, কিউবার স্বাধীনতা আন্দোলনসহ নানা বৈশ্বিক মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নেন। একইসাথে তিনি ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য নিয়েও সতর্ক ছিলেন এবং বাংলাদেশকে এক আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইতেন।

🟢 “ভোটের রাজনীতি”-র বাইরে একটি আদর্শিক সংগ্রাম

ভাসানী প্রচলিত রাজনীতির মানদণ্ডে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বারবার বলেছেন, “ভোট নয়, পরিবর্তন চাই।” তাঁর রাজনীতি ছিল গণমুখী, দূরদর্শী ও আদর্শনির্ভর। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান কখনোই একদলীয় কিংবা ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছিল না। তিনি কখনো মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেননি, বরং সাধারণ মানুষের জন্য আন্দোলনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

🟢 ন্যায়ের সংগ্রামে আপসহীনতা

ভাসানী ছিলেন আপসহীন নেতা। যখন আওয়ামী লীগ জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করে, তখন তিনিই ছিলেন প্রথম বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর। তিনি ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে ন্যাপ গঠন করেন। তার বক্তব্য ছিল: “কাজ না করলে, মানুষের পাশে না দাঁড়ালে, দল দিয়ে কী হবে?” তিনি রাজনীতিকে সেবার মাধ্যম হিসেবে দেখতেন, ব্যবসা বা ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে নয়।

 

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল একাধারে ইসলামি নৈতিকতা, প্রগতিশীল চিন্তাধারা, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তিনি ছিলেন এক দৃষ্টান্তমূলক আদর্শবান নেতা, যিনি নিজে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন, কিন্তু অন্যদের জন্য লড়তেন সাহসিকতা ও নিষ্ঠার সাথে। আজও তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে।

মাওলানা ভাসানী ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি সবসময় গরিব, কৃষক ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন — ধর্ম ও রাজনীতিকে সমন্বয় করে প্রগতিশীল সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিলেন দল-মতের ঊর্ধ্বে এক অসাধারণ দেশপ্রেমিক ও ন্যায়ের প্রতীক।

 

বিস্তারিত পড়ুনঃ
মেট্রোরেলের সময়সূচি ও ভাড়ার তালিকা ২০২৫। ঢাকা মেট্রোরেল স্টেশন ও ভাড়া বিস্তারিত

 

FAQ (Frequently Asked Questions)

❓ মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি কী ছিল?

উত্তর:
ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ।

❓ তিনি কি বামপন্থী রাজনীতির অনুসারী ছিলেন?

উত্তর:
হ্যাঁ, মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির অগ্রদূতদের একজন। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP) গঠন করে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করেন।

❓ তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে কীভাবে দেখতেন?

উত্তর:
ভাসানী ধর্মকে বিভেদ নয়, বরং ন্যায়ের শক্তি হিসেবে দেখতেন। তিনি ইসলামি নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে রাজনীতির সাথে সমন্বয় করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশ্বাসী ছিলেন।

❓ কেন তাঁকে “মজলুম জননেতা” বলা হয়?

উত্তর:
কারণ তিনি সবসময় সাধারণ জনগণ, কৃষক-শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলতেন এবং তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন।

❓ মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ আজকের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক কি?

উত্তর:
অবশ্যই। দুর্নীতি, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন অবস্থান আজকের সময়েও প্রাসঙ্গিক। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এখনও প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য অনুপ্রেরণা।