
গীবত সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমান সমাজে এমন কিছু গুনাহ রয়েছে, যেগুলো মানুষ অবলীলায় করে অথচ তা ভয়াবহ। এর একটি হলো গীবত (পরনিন্দা)। মানুষ ভাবে এটি ক্ষুদ্র, অথচ ইসলামে গীবতকে ভয়ংকর গোনাহ বলা হয়েছে। গীবত মানে কারো অনুপস্থিতিতে এমন কিছু বলা, যা সে শুনলে কষ্ট পায়। কুরআন ও হাদীস গীবতের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে।
গীবত সম্পর্কে কুরআনের স্পষ্ট আয়াত:
সূরা হুজুরাত – আয়াত ১২
وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ
বাংলা অর্থ:
"তোমরা একে অপরের গীবত কোরো না। তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে, সে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা ঘৃণা করো।"
📚 সূরা হুজুরাত (৪৯:১২)
আয়াতের ব্যাখ্যা:
এই আয়াতে গীবতের ভয়াবহতা এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেন এটি কারো মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতো জঘন্য কাজ। গীবত শুনতে সাধারণ মনে হলেও আল্লাহ্র দৃষ্টিতে তা ভয়ংকর অপরাধ।
🔹 উদাহরণ: কেউ যদি বলেন — "সে তো গোঁড়া মানুষ", "ওর চরিত্র খারাপ", অথবা "সে তো অমুক কাজ করে" — এধরনের কথা যদি সত্যও হয়, তবুও তা গীবত।
আরো পড়ুনঃ
সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত, হাদিস ও ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি
গীবতের ভয়াবহতা নিয়ে হাদিসসমূহ:
✅ ১. গীবত কী? রাসূল ﷺ ব্যাখ্যা করেন
হাদিস:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا الْغِيبَةُ؟ قَالَ: "ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ". قِيلَ: أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ؟ قَالَ: "إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ".
বাংলা অনুবাদ:
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, বলা হল: হে আল্লাহর রাসূল ﷺ, গীবত কী? তিনি বললেন:
"তোমার ভাইয়ের এমন কথা তার অনুপস্থিতিতে বলা, যা সে অপছন্দ করে।"
জিজ্ঞেস করা হলো: "যদি সে দোষটা তার মধ্যে থাকে?"
রাসূল ﷺ বললেন: "তবুও তুমি গীবত করেছো। আর যদি না থাকে, তবে তুমি তাকে অপবাদ দিয়েছো (বুহতান)।"
📘 সহিহ মুসলিম: ২৫৮৯
✅ ২. গীবতকারীর আমল ধ্বংস হয়ে যায়
হাদিস:
إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ، يُذْكَرُ بِهَا أَخَاهُ بِغَيْبِهِ، يَجْهَرُ بِهَا، يَسْقُطُ بِهَا فِي النَّارِ مَسِيرَةَ سَبْعِينَ خَرِيفًا
বাংলা অনুবাদ:
“এক ব্যক্তি এমন একটি কথা বলে যা দ্বারা সে তার ভাইকে পেছনে সমালোচনা করে (গীবত করে)। সেই কথার কারণে সে জাহান্নামে এমনভাবে পড়ে যায়, যেন ৭০ বছর নিচে পড়ে যাচ্ছে।”
📘 তিরমিযি: ২৩১৯, হাদিসটি হাসান সহিহ
✅ ৩. গীবতকারীর মুখ চুলকিয়ে চুলকিয়ে আঁচড়ানো হবে
হাদিস (স্বপ্নে রাসূল ﷺ-এর দেখানো শাস্তি):
نَبِيُّ اللَّهِ قَالَ: فَانْطَلَقْنَا، فَأَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُسْتَلْقٍ لِقَفَاهُ، وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ، وَإِذَا هُوَ يَهْوِي بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ فَيَفْلَقُهُ، فَيَتَدَهْدَهُ الْحَجَرُ...
বাংলা অনুবাদ (সংক্ষেপিত):
রাসূলুল্লাহ ﷺ এক রাতে স্বপ্নে জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.)-এর সাথে এক ব্যক্তিকে দেখলেন, যিনি অন্য একজনের মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ করছে। জিজ্ঞেস করলে বলা হলো,
“এই ব্যক্তি কেয়ামত পর্যন্ত এমন শাস্তি পাবে, কারণ সে গীবত করত।”
📘 সহিহ বুখারি: ৭০৪৭
✅ ৪. গীবতকারীর আমলনামা দানশীল ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া হবে
হাদিস:
«مَنْ اغْتَابَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ فَقَدْ أَفْسَدَ صَوْمَهُ، وَنَقَضَ وُضُوءَهُ، وَجَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُفِيضُ مِنْ فَمِهِ قَيْحًا، يَتَقَذَّرُهُ أَهْلُ الْمَوْقِفِ»
বাংলা অনুবাদ:
"যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গীবত করল, তার রোজা নষ্ট হয়ে গেল, ওজু ভঙ্গ হয়ে গেল। কিয়ামতের দিন তার মুখ থেকে পুঁজ বের হবে, যার দুর্গন্ধে আশপাশের লোকজনও বিরক্ত হবে।"
📘 তাবরানি, আল-কবীর (বিশ্বস্ত সনদ সহ)
গীবতের ক্ষতি ও প্রভাব:
আল্লাহর নিকট গোনাহগার হয়
সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়
আখিরাতে পাপের বোঝা বাড়ে
নিজের নেক আমল অন্যের নামে লেখা হয়
হাদীসে গীবতের শাস্তি:
রাসূল (ﷺ) বলেন:
“তুমি কি জানো গীবত কী?” সাহাবীগণ বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।’
তিনি বললেন, “তোমার ভাইয়ের এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে।”
একজন সাহাবি বললেন, “যদি সে কথাটি তার মধ্যে থাকে?”
রাসূল বললেন, “তাহলে সেটাই গীবত। আর যদি না থাকে, তবে সেটা তো বুহতান (অপবাদ)!”
📚 সহীহ মুসলিম: ২৫৮৯
গীবত থেকে বাঁচার উপায়:
নিজের কথা যাচাই করে বলা
অপ্রয়োজনে কাউকে আলোচনা না করা
গীবত হলে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেওয়া
তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা
যার গীবত করেছি, তার কাছে ক্ষমা চাওয়া
উপসংহার:
ইসলামে গীবত এমন একটি গোনাহ যা অনেকেই না জেনে করে ফেলে। অথচ কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তা থেকে আমাদের কঠোরভাবে বারণ করেছেন।
আসুন, আমরা গীবত পরিহার করি, দুনিয়াতে শান্তি ও আখিরাতে মুক্তির পথ বেছে নিই।
গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো জঘন্য পাপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি বোঝাতে চাওয়া হয়েছে, যেমন কেউ মৃত মানুষের গোশত খেতে ঘৃণা করে, তেমনি কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চাও উচিত নয়।
📣 পাঠকের প্রতি আহ্বান:
✋ আজ থেকে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করুন — আর কোনো গীবতে জড়াবেন না।
🕌 নিজে বাঁচুন, পরিবার-পরিবেশকেও গীবতমুক্ত রাখুন।
📢 এই গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক তথ্যটি নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। আপনার বন্ধু-পরিজনদের সাথেও শেয়ার করুন, যেন তারাও সঠিক নিয়তের মাধ্যমে ইবাদত করে।
হোক এটি সকলের হিদায়াত ও নাজাতের সোপান।
গীবত সম্পর্কে সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
🔹 ১. গীবত কী?
উত্তর:
গীবত হল, কারো অনুপস্থিতিতে এমন কিছু বলা যা সে শুনলে কষ্ট পাবে—যদিও সেটি সত্য হয়। এটি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
২. গীবত ও অপবাদ (বুহতান) এর পার্থক্য কী?
উত্তর:
গীবত হচ্ছে কারো সত্য দোষ অন্যের কাছে বলা, আর অপবাদ বা বুহতান হল—কারো সম্পর্কে মিথ্যা দোষারোপ করা। উভয়টাই গুনাহ, তবে বুহতান আরও ভয়াবহ অপরাধ।
৩. গীবত করলে কী শাস্তি হবে?
উত্তর:
কুরআন ও হাদীসে গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো ভয়ানক গুনাহ বলা হয়েছে। কিয়ামতের দিন গীবতকারীর নেক আমল ভুক্তভোগীকে দিয়ে দেওয়া হবে।
৪. আমি যদি সত্য বলি, তাহলে কি গীবত হবে?
উত্তর:
হ্যাঁ। যদি তা অপমানজনক হয় এবং সে ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকে—তাহলে তা গীবত। রাসূল ﷺ বলেন, “তোমার বলা কথাটি যদি সত্যও হয়, তবে সেটাই গীবত।”
৫. গীবত থেকে বাঁচার উপায় কী?
উত্তর:
চুপ থাকা
কারো অনুপস্থিতিতে তার প্রশংসা করা
নিজেকে আত্মসমালোচনায় ব্যস্ত রাখা
ভালো বন্ধু বেছে নেওয়া
তাওবা ও ইস্তিগফার করা
৬. গীবতের কারণে রোজা নষ্ট হয়ে যায় কি?
উত্তর:
রোজা বাতিল না হলেও এর সাওয়াব চলে যায়। রাসূল ﷺ বলেন:
"অনেক রোজাদার আছে, যার রোজা থেকে ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া কিছুই লাভ হয় না।" (সহিহ হাদিস)
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.