
বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম , নিয়ত, দোয়া কনুত ও হাদিস অনুযায়ী রাকাত সংখ্যা
বিতর সালাত ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত, বিশেষ করে রাতের নামাজের অংশ হিসেবে। এটি নিয়ে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে, যার মধ্যে কিছুতে এর ওয়াজিব হওয়ার গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। "বিতর সালাত" (وِتر) অর্থাৎ রাতে পড়া বিজোড় রাকাতের নামাজ — এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। এটি তাহাজ্জুদের পরে বা ইশার নামাজের পরে পড়া হয়।
বিতর নামাজের নিয়ম এখানে বিতর সালাতের সঠিক হাদীসসমূহ তুলে ধরা হলো:
১. বিতর সালাতের গুরুত্ব:
📗 হাদীস:
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
"আমার প্রিয় বন্ধু (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে তিনটি বিষয় অসিয়ত করেছেন... তার একটি হচ্ছে প্রতি রাতেই বিতর নামাজ পড়া।"
— (📘 সহিহ বুখারী: 1178, 📘 সহিহ মুসলিম: 721)
🔹 এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, বিতর নামাজের গুরুত্ব কত বেশি। রাসূল ﷺ এটি প্রতিদিন পড়তেন।
২. বিতর নামাজ কত রাকাত ও সহিহ নিয়ম কোনটি ও কিভাবে পড়তেন?
📗 হাদীস:
আয়েশা (রাঃ) বলেন:
"রাসূলুল্লাহ ﷺ বিতর নামাজ ১১ রাকাত পড়তেন। তাতে তিনি এত দীর্ঘ কিয়াম করতেন যে আপনি ভাবতেন তিনি রুকু করবেনই না।"
— (📘 সহিহ বুখারী: 1147, 📘 সহিহ মুসলিম: 738)
✅ কিন্তু, রাসূল ﷺ কখনো ৩ রাকাতেও বিতর পড়েছেন—এটিও প্রমাণিত।
✋ ৩. তিন রাকাত বিতর কিভাবে পড়তেন?
বিতর নামাজের টানা তিন রাকাত পড়া হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিয়মিত অভ্যাস, এবং হানাফি মাযহাব অনুসারে এটি উত্তম ও সুন্নাত তরীকায় পড়ে থাকে।
টানা ৩ রাকাত বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম (হানাফি মতে):
👉 ১ম ও ২য় রাকাতের মতোই শুরু করবেন,
👉 ৩য় রাকাতে কুনুত দোয়া পড়া হবে সুরা ইখলাসের পরে,
👉 এরপর রুকু, সিজদা, তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া পড়ে সালাম ফিরাবেন।
বিতর নামাজের ধাপসমূহ (Step-by-Step bitor salat):
🟢 প্রথম রাকাত:
নিয়ত করুন:
🗣️ “আমি তিন রাকাত বিতর নামাজ আল্লাহর জন্য আদায় করছি।”
তাকবীরে তাহরিমা (👐 আল্লাহু আকবার)
সানা (সুবহানাকাল্লাহুম্মা...)
সুরা ফাতিহা
সুরা (সুরা আল-আ'লা পড়া সুন্নাত)
রুকু, সিজদা
🟢 দ্বিতীয় রাকাত:
সুরা ফাতিহা
সুরা কাফিরুন
রুকু, সিজদা
তারপর ওঠে দাঁড়ান তৃতীয় রাকাতের জন্য (তাশাহহুদ নয়)
🟢 তৃতীয় রাকাত:
সুরা ফাতিহা
সুরা ইখলাস
এরপর হাত তুলে তাকবীর বলুন:
👐 “আল্লাহু আকবার”
তারপর হাত বেধে কুনুত দোয়া পড়ুন
এরপর রুকু, সিজদা
তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া
দুপাশে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করুন
📗 হাদীস:
উবাই ইবনে কাব (রাঃ) বলেন:
"রাসূলুল্লাহ ﷺ বিতর নামাজে সূরা আল-আ’লা, সূরা কাফিরুন এবং সূরা ইখলাস পড়তেন।"
— (📘 আবু দাউদ: 1423, 📘 তিরমিযী: 463 – হাসান সহীহ)
🔹 প্রথম রাকাতে: সুরা আল আ’লা (سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى)
🔹 দ্বিতীয় রাকাতে: সুরা কাফিরুন (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ)
🔹 তৃতীয় রাকাতে: সুরা ইখলাস (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ)
এক রাকাত বিতরের হাদীস:
১ রাকাত বিতর নামাজ হাদিস ও ৩ রাকাত বিতর নামাজ হাদিসে বিদ্যমান। নিচে হাদিসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
📗 হাদীস:
ইবনে উমর (রাঃ) বলেন:
"নবী ﷺ বলেছেন: ‘রাতের নামাজ দু’টি দু’টি করে হয়। তবে তোমাদের কেউ যদি ফজরের আশঙ্কা করে, সে যেন এক রাকাত পড়ার মাধ্যমে তার নামাজকে বিজোড় করে (বিতর বানিয়ে) ফেলে।’"
— (📘 সহিহ বুখারি: 990, 📘 সহিহ মুসলিম: 749)
🔹 এই হাদীসে এক রাকাত বিতরের স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। অর্থাৎ, রাতের নামাজ শেষে একজন ব্যক্তি যদি এক রাকাত পড়ে, তবে সেটিই হবে বিতর।
🤲 ৪. কুনুত দোয়া আছে কি?
হ্যাঁ, রাসূল ﷺ বিতর নামাজে কখনো কখনো "দু'আয়ে কুনুত" পাঠ করেছেন।
হাদীস:
উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বলেন:
“রাসূল ﷺ বিতরের তৃতীয় রাকাতে কুনুত পড়তেন।”
— 📘 (তিরমিযী: 464, হাসান সহীহ)
আরেক হাদীসে আছে:
“রাসূলুল্লাহ ﷺ বিতরের তৃতীয় রাকাতে কুনুত দোয়া পড়তেন কিয়াম অবস্থায়।”
— 📘 (আবু দাউদ: 1425)
🔹 কুনুতের আগে কুনুত তাকবীর “আল্লাহু আকবার” বলে হাত উঠানো হাদীসে প্রমাণিত।
📗 হাদীস:
"রাসূল ﷺ বিতরে কুনুত দোয়া পাঠ করতেন, কখনো কখনো রুকুর আগে, আবার কখনো পরে।"
— (📘 নাসাঈ: 1700, 📘 আবু দাউদ: 1425)
৩। বিতর নামাজের দোয়া কুনুত (দু'আয়ে কুনুত):
আরবি উচ্চারণ (বাংলা হরফে):
আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈনুকা ওয়া নাস্তাগফিরুকা ওয়া নুওমিনু বিকা ওয়া নাতাওয়াক্কালু ‘আলাইকা ওয়া নুছনীকু আলাইকাল-খাইর ওা নাশকুরুকা ওা লা নাকফুরুকা ওা নাখলা‘উ ওয়া নাটরুকু মাইয়্যাফজুরুক আল্লাহুম্মা ইইয়্যাকা না‘বুদু ওা লাকা নুসল্লী ওয়া নাসজুদু ওা ইলাইকা নাস‘আ ওয়া নাহফিজ নারজু রহমাতাকা ওা নাখশা ‘আজাবাকা ইন্না ‘আযাবাকা বিল-কুফ্ফারি মুলহিক।
📖 বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য চাই,
তোমারই নিকট ক্ষমা চাই,
তোমারই প্রতি ঈমান রাখি,
তোমারই ওপর ভরসা করি।
তোমারই প্রশংসা করি উত্তমভাবে।
আমরা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ,
অকৃতজ্ঞ হই না।
আমরা তাদের থেকে বিরত থাকি ও দূরে থাকি যারা তোমার অবাধ্য।
হে আল্লাহ! একমাত্র তোমারই ইবাদত করি,
তোমারই জন্য নামাজ পড়ি এবং সিজদা করি।
তোমারই দিকে আমরা চেষ্টা করি ও ধাবিত হই।
আমরা তোমার রহমতের আশা করি
এবং তোমার শাস্তিকে ভয় করি।
নিশ্চয়ই তোমার শাস্তি কাফেরদের ঘিরে ফেলবে।
✅ এই দোয়াটি আপনি তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস পড়ার পর, রুকুতে যাওয়ার আগে (বা কিছু আলেমের মতে পরে) উঠে দাঁড়িয়ে পড়বেন।
৪। বিতর নামাজের নিয়তঃ
বিতর নামাজের জন্য নিয়ত (নিয়াহ) সম্পর্কে সরাসরি হাদীসে কোনো নির্দিষ্ট বাক্য পাওয়া যায় না। বরং রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং সাহাবাগণ মনে মনে ইচ্ছা করতেন—এই নামাজ আল্লাহর জন্য, এটি বিতর নামাজ—এটাই ছিল তাঁদের নিয়ত।
📌 হাদীস থেকে মূলনীতি:
✅ “নিয়ত হল অন্তরের কাজ” — মুখে উচ্চারণ করা রাসূল ﷺ কখনো করেননি।
📗 হাদীস:
"إنما الأعمال بالنيات، وإنما لكل امرئ ما نوى..."
অর্থ: “সব কাজই নিয়তের উপর নির্ভর করে, আর মানুষ তার নিয়তের অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।”
— 📘 (সহিহ বুখারি: ১, সহিহ মুসলিম: ১৯০৭)
🔹 তাই, নিয়ত মনের বিষয় — আপনি যদি মনে মনে চিন্তা করেন:
“আমি এখন ৩ রাকাত বিতর নামাজ আল্লাহর জন্য পড়ছি”
👉 সেটাই যথেষ্ট, এবং এটিই হাদীসের আলোকে সঠিক।
✅ সংক্ষেপে বিতর সালাতের সঠিক পদ্ধতি:
৩ রাকাত পড়া সুন্নত (২+১ নয়, বরং টানা তিন রাকাত)।
৩টি সূরা:
১ম রাকাত: সূরা আল আ'লা
২য় রাকাত: সূরা কাফিরুন
৩য় রাকাত: সূরা ইখলাস
৩য় রাকাতে রুকুর আগে বা পরে কুনুত দোয়া পড়া সুন্নত।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.