
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান 2025
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমাত্রিক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই প্রশাসন, রাজনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (TI) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ একসময় টানা পাঁচ বছর (২০০১-২০০৫) বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে এখনো ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, সরকারি টেন্ডার দুর্নীতি, ভূমি দখল, নিয়োগে অনিয়ম, এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা ধরণের দুর্নীতি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করে এবং নানা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার (Zero Tolerance) নীতির কথা বললেও বাস্তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিবাজরা আইনের আওতার বাইরে থেকে যায় বা প্রভাব খাটিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। অন্যদিকে, সাধারণ জনগণ প্রশাসনিক কাজকর্মে নানা সময় ঘুষ না দিলে সেবা থেকে বঞ্চিত হন, যা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও জবাবদিহিতার অভাব দুর্নীতিকে আরও প্রশ্রয় দিয়েছে।
তবে আশার কথা হলো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বৃদ্ধি, নাগরিক সচেতনতা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে কিছু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা ভবিষ্যতে দুর্নীতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে দুর্নীতির মূল উৎপাটনের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শক্তিশালী প্রশাসনিক সংস্কার এবং কার্যকর বিচারব্যবস্থা।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান: ২০২৪

২০২৪ সালে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (TI)–এর দুর্নীতির ধারণা সূচক (CPI) অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৪তম স্থানে রয়েছে। আগের বছর ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০ম, অর্থাৎ সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে। তবে এই অগ্রগতি দুর্নীতি হ্রাস পাওয়ার ফল নয়। বরং বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ সালের ২৪ থেকে কমে ২০২৪ সালে হয়েছে মাত্র ২৩, যা দুর্নীতির বৃদ্ধি নির্দেশ করে। কিন্তু অন্য কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা উপরে উঠেছে।
সিপিআই সূচকে ০ মানে হচ্ছে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ মানে দুর্নীতিমুক্ত। সে হিসেবে বাংলাদেশের স্কোর ২৩ মানে হলো দুর্নীতির উচ্চমাত্রা এখনো দেশের প্রশাসন, রাজনীতি এবং আর্থসামাজিক খাতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। এ প্রতিবেদনটি ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এবং রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি আনুষ্ঠানিকভাবে এটি প্রকাশ করে। অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, বাংলাদেশের অবস্থান চার ধাপ উন্নত হলেও দুর্নীতির মাত্রা কমেনি, বরং স্কোর কমে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র আরও উদ্বেগজনক রূপ ধারণ করেছে।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র (২০২৪–২৫)
Transparency International–এর Corruption Perceptions Index (CPI) ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩/১০০ স্কোর, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, এবং বিশ্বের ১৫১তম স্থান দখল করেছে—২০২৩ সালের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নামেছে । এই স্কোর বিশ্ব গড় (৪৩)–এর থেকে প্রায় ২০ পয়েন্ট কম, যা দেশের দুর্নীতিবোধের “খুব গুরুতর সমস্যা” নির্দেশ করে ।
দক্ষিণ এশিয়ায়, শুধু আফগানিস্তানই বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে । বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশেও পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হলেও, বাংলাদেশ–এর পতন একাধিক কারণ—যেমন আত্মপ্রশাসনের দুর্বলতা, সরকারি প্রকল্পে ঘুষদানের বিস্তার, বিচার ও প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভাব—এই পতনের মূল চালিকা ।
TIB–এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত বছর দুর্নীতির অভিযোজনাধীনের ব্যবস্থা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার ব্যাঘাতের কারণে এই পতন ঘটেছে। মাটির নিচে স্থাপিত দুর্নীতির সংস্কৃতি এবং কর্নার–কেস (high‑level corruption) এখনও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর চেষ্টাকে হীন করছে ।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব স্পষ্ট: বিনিয়োগ–আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ক্লাইমেট ফান্ডসহ বিভিন্ন অনুদান দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । তবে এটি একটি একক পয়েন্ট–ড্রপ নয়—এটি একটি অব্যাহত পতনের অংশ, যা নির্দেশ করে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
উপান্তে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ প্রসারিত:
- ACC’র স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি
- শৃঙ্খলাবদ্ধ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ
- প্রশাসন ও রাজনৈতিক সংস্কার
- নাগরিক সচেতনতা ও গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি
- আমদানী ও প্রকল্প কার্যক্রমে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন ।
বাংলাদেশ বর্তমানে দুর্নীতির পরিমাপে দারুণভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বস্ততার মানদণ্ডে দেশের অবস্থান সংকটাপন্ন—যা দূর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, বিচার ও নাগরিক অংশগ্রহণের একটি সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বিস্তারিত পড়ুনঃ
সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের নিয়ম ২০২৫ | আইন, রায় ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের জিজ্ঞাসাঃ
❓ ২০২৫ সালে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
বাংলাদেশ ২০২৫ সালে দুর্নীতির ধারণা সূচকে (CPI) বিশ্বের ১৪তম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অবস্থান নিয়েছে। এর অর্থ হলো দুর্নীতির মাত্রা অনেক উচ্চ মাত্রায় রয়েছে।
❓ বাংলাদেশ কেন দুর্নীতিতে চার ধাপ এগিয়েছে, কিন্তু স্কোর কমেছে?
বাংলাদেশের স্কোর ২০২৪ সালে ২৩ থেকে ২০২৫ সালে কমে ২৪ হয়েছে, অর্থাৎ দুর্নীতি বেড়েছে। কিন্তু অন্য দেশের দুর্নীতি আরও বেশি হওয়ায় তুলনায় অবস্থান উন্নত হয়েছে।
❓ CPI সূচক কীভাবে কাজ করে?
CPI সূচকে ০ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কোর দেয়া হয়। ০ মানে দুর্নীতির সর্বোচ্চ মাত্রা এবং ১০০ মানে দুর্নীতিমুক্ত দেশ।
❓ বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রধান কারণ কী কী?
প্রধান কারণগুলো হলো প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, স্বচ্ছতার অভাব, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং নাগরিক সচেতনতাহীনতা।
❓ দুর্নীতি কমানোর জন্য বাংলাদেশে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
দুর্নীতিবিরোধী কমিশন (দুদক) কার্যক্রম চালাচ্ছে, ডিজিটালাইজেশন বাড়ানো হচ্ছে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.